শনিবার ।। ১৭ জিলকদ, ১৪৪৬।। ৩ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ ।। ১৭ মে, ২০২৫
     হাফেজ মোঃ ইদ্রিস আলী
মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা, যার কথা বিরামপুরবাসি আজিবন শ্রদ্ধাভরে মনে রাখবে।

                    মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ইতিহাস: আলোর পথে এক অমর যাত্রা

১৯৭৮ সালের কথা। বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চল বিরামপুর, যেখানে শিক্ষার আলো তখনও অনগ্রসর। সেই অন্ধকারে একটি দীপশিখার মতো উদ্ভাসিত হন হাফেজ ইদ্রীস আলী, একজন ধর্মপ্রাণ ও বিদ্যোৎসাহী মানুষ। তিনি ছিলেন বিরামপুর মসজিদের ইমাম এবং একজন দূরদর্শী স্বপ্নদ্রষ্টা, যিনি চেয়েছিলেন বিরামপুর এলাকার ছেলে-মেয়েদের আধুনিক ও ইসলামী শিক্ষার সমন্বয়ে গড়ে তুলতে। তার হৃদয়ে জ্বলছিল একটি আকাঙ্ক্ষা—একটি এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, যা কুরআনের জ্ঞান দিয়ে সমাজকে আলোকিত করবে।

স্বপ্নের সূচনা ও প্রথম পদক্ষেপ

হাফেজ ইদ্রীস আলী স্থানীয় কিছু শিক্ষানুরাগী ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন এবং একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তার প্রিয় ওস্তাদ মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.)-এর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মাদ্রাসাটির নামকরণ করা হয় বিরামপুর শামসুল উলুম হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা

শুরুর দিনগুলো ছিল চ্যালেঞ্জে ভরা। কোনো উন্নত স্থাপনা তো দূরে থাক, মাদ্রাসা কার্যক্রম শুরু হয়েছিল স্থানীয় মসজিদের জায়গায় একটি সাধারণ টিনশেড ঘর তৈরি করে। সেই ঘরটি ছিল শিক্ষা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, যেখানে আল কোরআনের আলো ছড়িয়ে পড়ত। শত সংকট সত্ত্বেও হাফেজ ইদ্রীস আলী এবং তার সহযোগীদের নিষ্ঠা মাদ্রাসাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে।

প্রতিষ্ঠার পেছনের মহৎ হৃদয়গুলো

মাদ্রাসার উন্নয়নে এককভাবে হাফেজ ইদ্রীস আলীর চেষ্টা ছিল না। তার পাশে ছিলেন কয়েকজন নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নামগুলো হলো:

  • মৃত ইসমাইল খান
  • মৃত ওয়াজেদ খান
  • মৃত ওমর আলী মোল্যা
  • মৃত মতলেব বিশ্বাস
  • মৃত আব্দুল আজিজ
  • মৃত আতিয়ার রহমান
    মৃত আব্দুস সাত্তার
  • আনোয়ার হোসেন
  • হাজী লিয়াকত আলী
  • মতিয়ার রহমান
  • নুর ইসলাম

এই মানুষগুলো শুধু অর্থায়নেই থেমে থাকেননি। নিজেদের হাতে ইট বহন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল-ধান সংগ্রহ, এমনকি নিজের শ্রম দিয়ে মাদ্রাসার প্রতিটি ধাপে সহযোগিতা করেছেন।

প্রথম অধ্যায়ের সমাপ্তি ও নতুন আলোর সন্ধান

১৬ বছরের কঠোর পরিশ্রম ও সাধনার পর, ১৯৯৪ সালে বিরামপুর মাদ্রাসার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। আল্লাহর রহমতে সরদার ওয়াকার হাসান (রাজু) নামের একজন দাতা তার জমি দান করেন। এই জমি ছিল মাদ্রাসার উন্নয়নের জন্য এক বিরাট নিয়ামত। দানের জমিতে একতলা পাকা ভবন নির্মাণ করা হয় এবং মাদ্রাসাটি নতুন উদ্যমে যাত্রা শুরু করে। এটি ছিল ইসলামী শিক্ষার বিস্তারের জন্য একটি মাইলফলক।

উন্নয়নের দ্বিতীয় অধ্যায়: অবকাঠামো ও শিক্ষার সমন্বয়

হাফেজ ইদ্রীস আলী যখন বয়সের ভারে ক্লান্ত হয়ে পড়েন, তখন মাদ্রাসার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন আরেক নিবেদিতপ্রাণ আলেম, হাফেজ মাওলানা আব্দুল্লাহ। তার নেতৃত্বে মাদ্রাসার অবকাঠামোগত উন্নয়ন আরও গতিশীল হয়। ১০ বছরের এই সময়ে প্রায় ৮০-৮৫ জন ছাত্র হাফেজ হিসেবে নিজেদের জীবন আলোকিত করে, যারা আজ বাংলার আনাচে-কানাচে কুরআনের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তিনি আজও সবার কাছে একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্মরণীয়।

সেবার নিঃস্বার্থ উদ্যোগ

মাদ্রাসার ইতিহাস শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের নয়, এটি অনেক ত্যাগী ও নিবেদিতপ্রাণ মানুষের গল্প। তারা নিজেরা ইট-কাঠ বহন করেছেন, নিজেদের শ্রম দিয়ে মাদ্রাসার উন্নয়ন করেছেন। এমনকি দরজায় দরজায় গিয়ে চাল-ধান সংগ্রহের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের খাদ্যের ব্যবস্থা করেছেন। তাদের এই ত্যাগ-তিতিক্ষা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত ছিল।

আজকের জামেয়া ইসলামিয়া শামসুল উলুম মাদ্রাসা

আজ এই মাদ্রাসা শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়; এটি একটি ঐতিহ্যের নাম। এটি ইসলামী শিক্ষার আলো ছড়ানোর পাশাপাশি অনাথদের আশ্রয় দিচ্ছে। এখানকার শিক্ষার্থীরা শুধু কুরআন হেফজই করছে না, বরং নিজেদের জীবনকে সুশিক্ষিত ও আত্মনির্ভরশীল করার জন্য প্রস্তুত করছে।

ভবিষ্যৎ লক্ষ্য ও উন্নয়ন পরিকল্পনা

মাদ্রাসার উন্নয়নের যাত্রা এখানেই শেষ নয়। এটি আরও এগিয়ে যেতে চায়। ভবিষ্যতে এই মাদ্রাসায় আধুনিক ইসলামী শিক্ষার সমন্বয়ে একটি মডেল প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হবে, যেখানে সমাজের প্রতিটি শিশুর জন্য জ্ঞানার্জনের সুযোগ থাকবে।

[লেখাটি অব্যাহত থাকবে…]